৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হওয়া দেশের নাম বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ৯ মাসে ৩০ লাখ লোক শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, যা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই ভাষণ শুনে সাত কোটি বাঙালির মধ্যে স্বাধীনতার ইচ্ছা প্রবলভাবে জাগ্রত হয়। ফলে ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে যখন বঙ্গবন্ধু বেতারবার্তার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা প্রদান করেন, সেই মুহূর্ত থেকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কোনো মানুষই স্থির ছিলো না। যার কাছে যা ছিলো তা নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে। চাকুরির কারণে যারা দেশের বাইরে ছিলেন তারাও মানসিকভাবে দেশের জন্যে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিতে থাকে। আজ চাঁদপুর কণ্ঠের পাঠকদের সামনে তেমনই একজন বীরসেনানী স্বাধীনতার সূর্যসন্তানের পরিচয় তুলে ধরবো। জানবো স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তিতে তাঁর অনূভূতি, অতৃপ্তিসহ নানা কথা।
এই বীর সেনানী হচ্ছেন ফরিদগঞ্জ পৌর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট (অবঃ) আব্দুস সামাদ পাটওয়ারী। তিনি জানান, ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ট্রেনিং শেষ করে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে অংশ নেই। সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর থেকে তাদের আচরণ পছন্দ ছিলো না। তারা সর্বদা বাঙালিদের অন্যায়ভাবে অত্যাচার ও হেয়প্রতিপন্ন করতো। প্রতিদিনের ট্রেনিং শেষে যখন সকলে বিশ্রামে যেতো, তখন আমাদেরকে কাজ করতে হতো। পাকিস্তানী সৈন্যরা নিজেরা কাজ না করে আমাদের দিয়ে বিশ্রামের সময় রেশন আনা-নেয়া এবং কাঠ কাটার কাজ করাতো। ফলে দিনের পর দিন আমাদের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মার্চের ১ তারিখে লাহোর থেকে দুটি জাহাজ বাংলাদেশের দিকে রওনা হয়। এসব জাহাজে প্রচুর পরিমাণে গোলাবারুদ ও অস্ত্র ছিলো। ওই দিনটি ঈদের দিন ছিলো। আমরা ঈদের নামাজ আদায় করলে দুপুর ১টায় জাহাজ ছেড়ে দেয়। আমরা যখন শ্রীলঙ্কার কলম্বো সমুদ্রবন্দরে তখন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দেন। আমাদের কাছে সেই খবর চলে আসে। আমরাও মনে মনে পাকবাহিনীর অন্যায় ও অত্যাচার থেকে দেশকে রক্ষার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকি। জাহাজ দুটি মার্চের ১৩ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে পেঁৗছলেও বন্দরে ভিড়তে দেয়নি। পরে ২৩ মার্চ দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে দুটি গান বোট নিয়ে অস্ত্রশস্ত্র এবং আমাদেরকে নিয়ে রওনা হয়। ভোর সাড়ে ৪টায় আমরা চট্টগ্রামের নতুন ফাঁড়িতে এসে নামলাম। এখানে আসার পরে দেখলাম আমাদের সৈনিকদের গুলি করে মারার কিছু দৃশ্য। পাকবাহিনী দেয়ালে লেগে থাকা রক্তের দাগ পানি দিয়ে মুছে ফেললেও আমাদের চোখ এড়ায়নি। আমার সাথে সেদিন ছিলো বরিশালের আব্দুল বারেক, ঢাকার রমিজ উদ্দিন ও ফরিদগঞ্জের সুবিদপুরের আবুল বাশার। আমরা এই চারজন একটি স্কুটারে চড়ে চেকপোস্টের কাছাকাছি চলে আসলাম। স্কুটার চালককে আগেই বলেছিলাম, আমাদেরকে রেলস্টেশনে নামিয়ে দিতে। চেকপোস্টে ওই সময়ে সৈনিক অদল-বদল হচ্ছিল। এই সময়েই স্কুটারের চালক একটানে চেকপোস্ট পার হয়ে যায়। এ সময় চেকপোস্টের সৈনিক গাড়ি থামাতে বললেও সে থামায়নি। আমরা চলে আসলাম রেলস্টেশনে। রেলগাড়িতে থাকার সময়েই একজন হাবিলদার বা মেজর পাঠান বংশের লোক আমাদের খোঁজে আসে। আমরা একটি টয়লেটে আশ্রয় নেই। পরে তারা আমাদের খুঁজে না পেয়ে চলে যায়। পরে আমি আমার এক তালাতো ভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নিই। সেখানে দুদিন থাকার পর তিনি একটি ট্রাকে আমাদের উঠিয়ে দেন। সেই ট্রাকে করে আমরা চাঁদপুরের কুমারডুগি নামক স্থানে নেমে যাই। আমি বাড়িতে এবং আমার অন্য সঙ্গী বাশার তার মতো করে চলে যায়।
পরবর্তীতে মার্চের শেষের দিকে আমিনুল হক মাস্টার, আবুল খায়ের পাটওয়ারী এবং আমি ৩টি থ্রিনটথ্রি বন্দুক দিয়ে এআর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে স্কুল ও কলেজের ছাত্রদের ট্রেনিং দেয়া শুরু করি। এপ্রিল মাসের ১০/১২ তারিখের দিকে পাকবাহিনী আসছে শুনে আমরা স্থান ত্যাগ করলাম। আমি জহিরুল হক পাঠান সাহেবের ট্রুপসে যোগদান করি। পরে সেই ট্রুপস-এর সদস্য হিসেবে আমরা সেনাবাহিনী, বিডিআরসহ যারা ছিলো সকলে মিলে ২৭ এপ্রিল পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গাজীপুরের প্রথম যুদ্ধে অংশ নিই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকুরি করাকালে আমার সাথে পরিচয় হয় মেজর এটিএম হায়দার সাহেবের সাথে। সেপ্টেম্বর আমি যখন ভারতের মেলাঘরে যাই, তখন আমার সাথে মেজর এটিএম হায়দার সাহেবের দেখা হয়। তিনি আমাকে তার গাড়ি চালক হিসেবে নিযুক্ত করেন। বাকি যুদ্ধের সময়ে আমি তাঁর সাথেই ছিলাম। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে আমি সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর সার্জেন্ট হিসেবে অবসর গ্রহণ করি। মুক্তিযোদ্ধা সংসদে আমি দপ্তর সম্পাদক, পৌর কমান্ডার এবং বর্তমানে পৌর ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে কাজ করছি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর কেমন আছেন, কী ভাবছেন জেনে নেই তাঁর কাছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কেমন আছেন?
আব্দুস সামাদ : যদি বলার জন্যে বলতে হয় তাহলে বলবো, ভালো আছি। এই বয়সে সবসময় ভালো থাকা যায় না। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের যেই সম্মান জানাচ্ছেন, তার জন্যে ভালো থাকতেই হবে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর পঞ্চাশ বছর বেঁচে থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দেখা পেলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার অনুভূতি কেমন?
আব্দুস সামাদ : দেশ স্বাধীন করেছি, লাল-সবুজের পতাকা, বাংলার মাটি, বাংলা ভাষা পাওয়ার জন্যে। যুদ্ধ করেছি বলেই এগুলো পেয়েছি। কিন্তু আমার মাঝে মাঝে বিবেকে বাঁধে, যেজন্যে এই যুদ্ধ করেছি, ভবিষ্যতে এগুলো ঠিক রাখতে পারবো কি না। কারণ শুধু স্বাধীনতা উপরের সবগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আওয়ামী লীগসহ রাজনৈতিক দলগুলো যদি সঠিকভাবে হাল না ধরে তবে স্বাধীনতা থাকলেও অনেক কিছুই বদলে যেতে পারে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেই স্বপ্নের সমান্তরালে দেশের অগ্রযাত্রা লক্ষ্য করছেন কি?
আব্দুস সামাদ : আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে। বঙ্গবন্ধু কাজ শেষ করতে না পারলেও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা দেশের জন্যে অনেক কিছু করছেন। আমার পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে আমাদের মন্ত্রী-এমপিসহ আমলারা যদি আরও ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে আরও দ্রুতগতিতে উন্নয়ন হবে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : দেশকে নিয়ে আপনার কোনো অতৃপ্তি আছে কি?
আব্দুস সামাদ : ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে কাজ শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির জন্যে বলা হলে আমরা ওই সময়ে ফরিদগঞ্জে ৩৬০ জনের এবং পরবর্তীতে প্রায় ২৯০/২৯৬ জনের তালিকা করি। মোট ৭৮২ জনের চূড়ান্ত তালিকা হয়। তারা ভাতা পেতে শুরু করে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে উল্টাপাল্টা কাজ শুরু করে। তারা বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা তৈরি শুরু করে। আমার মুক্তিযোদ্ধার কাগজে আমার ছবির উপর আরেক জনের ছবি বসিয়ে তাকে ভাতা দেয়া শুরু করে। আমিসহ ৮২ জন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বেশ ক'বছর ভাতা থেকে বঞ্চিত হই। আমি ১/১১-এর সময়ে সেনাবাহিনী প্রধান, দুর্নীতি দমন কমিশন, চাঁদপুরের ডিসি, এসপি এবং ইউএনও বরাবর আবেদন করি। আমি ও নবনির্বাচিত পৌর মেয়র আবুল খায়ের পাটওয়ারীসহ সেই তালিকা মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে পেঁৗছাই। পরবর্তীতে সুফল পেয়েছি। রাজনৈতিক দলাদলির কারণে কেনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এই অতৃপ্তি এখনো আমার মধ্যে কাজ করে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আপনি কাকে বা কাদেরকে বেশি স্মরণ করতে চান?
আব্দুস সামাদ : আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা, আমার সহযোদ্ধা এবং ১৯৭১ সালে শহীদ হওয়া সকলকে স্মরণ করছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : সকলের উদ্দেশ্যে আপনার পছন্দের কিছু কথা বলুন।
আব্দুস সামাদ : আমার কথা একটাই, মুক্তিযুদ্ধ একবারই হয়েছে, তাই মুক্তিযোদ্ধারা একবারই সৃষ্টি হয়েছে। কোনোভাবেই যেনো তাদের অবদানকে কেউ কোনোদিন খাটো করে না দেখেন। এদেশের মানুষ যেনো চিরকাল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে দেশের জন্যে কাজ করে যান।
পরিশেষে চাঁদপুর কণ্ঠকে অভিনন্দন। তারা স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীতে আমাদের কথা শোনার জন্যে।
ফজর | ৪:১৮ |
যোহর | ১১:৫৯ |
আসর | ৪:৩১ |
মাগরিব | ৬:২৪ |
এশা | ৭:৩৯ |
হেরার আলো
|
বাণী চিরন্তন
|
আল-হাদিস
|
৯৯-সূরা যিল্যাল ০৮ আয়াত, ১ রুকু, মাদানী পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। ৪। সেই দিন পৃথিবী তাহার বৃত্তান্ত বর্ণনা করিবে, ৫। কারণ তোমার প্রতিপালক তাহাকে আদেশ করিবেন, ৬। সেই দিন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দলে বাহির হইবে, যাহাতে উহাদিগকে উহাদের কৃতকর্ম দেখান যায়,
যার বশ্যতার মধ্যে তোমার স্বার্থ নিহিত, তার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ো না। _এরিস্টিটল।
যে শিক্ষিত ব্যক্তিকে সম্মান করে, সে আমাকে সম্মান করে
|
করোনা পরিস্থিতি | ||
বাংলাদেশ | বিশ্ব | |
আক্রান্ত | ৬,৪৪,৪৩৯ | ১৩,২১,৯৪,৪৪৭ |
সুস্থ | ৫,৫৫,৪১৪ | ১০,৬৪,২৬,৮২২ |
মৃত্যু | ৯,৩১৮ | ২৮,৬৯,৩৬৯ |
দেশ | ২১৩ | |
সূত্র: আইইডিসিআর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। |
হ্যাঁ | না | মতামত নেই |